“এ জীবনের কোনো মানে হয়?”
-সোনাবান/ছকাজান বানু।
গাইবান্ধার সোনাবান/ছকাজান বানু। সাত সন্তানের মা। স্বামী ছিলেন ভবঘুরে। হ্ঠাৎ হ্ঠাৎ হতেন নিরুদ্দেশ। যুদ্ধের সময় প্রসূতি স্ত্রী আর দুই সন্তান রেখে চলে গিয়েছিলেন নিরুদ্দেশে। মানুষের ঘরে কাজ করে সংসার চালাতেন সোনাবান। দরিদ্র ও অসুস্থ সোনাবান দেখেন সব হিন্দু তার এলাকা ছেড়ে দিচ্ছে। জান বাঁচাতে হিন্দুরা বাড়িঘর, মালামাল সব ফেলে চলে যায় ভারতে। তার ধারণা হয়, যুদ্ধ সম্ভবত হিন্দুদের জন্য। বাকিদের জন্য নয়। তিনি দুই সন্তান নিয়ে থেকে গেলেন। চেয়েচিন্তে খাবার জোগাড় করতেন। একসময় তাও আর সম্ভব হয়ে উঠেনি সন্তান প্রসবের দিন ঘনিয়ে আসায়। তৃতীয় সন্তান প্রসবের পর টানা তিনদিন ঘরের কারো খাবার জুটেনি পেটে। বাচ্চাদের কান্নায় দুমড়ে ওঠে সোনাবানের বুক। তিনদিনের বাচ্চাকে শাড়িতে মুড়ে বাকি দুই বাচ্চার হাত ধরে নেমে পড়েন কচু তুলতে।ক্ষত তার তখনো শুকায়নি। তার এ করুণ অবস্থা দেখে খাবার খেতে দেন বসন্ত সাহা নামে এলাকার এক লোক। খাবার খেয়ে সন্তানসহ বাড়ি ফেরার পথেই হানাদার বাহিনীর এক লোক আক্রমণ করে তাকে ও তার ছেলেমেয়েকে। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় বসন্ত সাহার বাড়ি, এক ঘরে ঢুকে তার সন্তানদের সামনে তাকে নির্যাতন করে টানা তিনঘন্টা। যে ক্ষত শুকোয়নি সেই ক্ষতই আরো গভীর হয়েছে। রক্তে ভেসে গেছে ঘর। সোনাবানের ভাষ্যমতে গরু জবাই দিলে যেমন হয় সেদিন তেমন অবস্থাই হয়েছিল। ছেলেমেয়ে তাকে রেখে পালিয়ে যায়। সোনাবান মেঝেতে পড়ে থাকেন জ্ঞান হারিয়ে। জ্ঞান ফেরার পর তার সন্তানদের কথা মনে পড়লে নিজেই হেঁটে নদীতে যান আর গোসল করে ঘরে ফেরেন। গিয়ে দেখেন সন্তানেরা বসে আছে মায়ের অপেক্ষায়। যুদ্ধ শেষে তার স্বামী ফিরে আসেন। সব শুনার পর মেনে নেন তার স্ত্রীকে। এরপরে তাদের ঘরে আসে আরো চার সন্তান।
দুঃখিনী সোনাবান চিরদিন দুঃখিনীই রয়ে গেছেন। বীরাঙ্গনা হওয়া স্বত্ত্বেও পাননি কোনো সরকারি অনুদান। দৌড়ঝাঁপ করেও নাম লেখাতে পারেননি বীরাঙ্গনাদের খাতায়। হয়নি তার নিজের কোনো ভিটা। মানবেতর দিনযাপন পিছু ছাড়েনি তার। দেশ স্বাধীনের পরও মানুষের ঘরে কাজ করতেন। ছেলেমেয়ে মানুষও হয়নি। কেউ কখনো শুনতে আসেনি তার কথা। কেউ জিজ্ঞেস করেনি হালচাল। সোনাবান আর আশা করেননা যথাযথ সম্মান। শুধুমাত্র পুষে রেখেছেন ক্ষোভ দাম না পাওয়ার। স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হারিয়ে ফেলার দাম।
লেখা: তাসমীমা আহমেদ।
তথ্যসূত্র: বীরাঙ্গনার আত্মকথন, ড. শেখ আবদুস সালাম, শিল্পী বেগম।
ক্রিয়েটিভ: ওয়াহিব অমিও।