বরাবরের মতই এবারের নোবেল নিয়েও চলছিলো বিস্তর জল্পনা-কল্পনা। ফেভারিটের তালিকেয় ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, জলবায়ু আন্দোলনকর্মী কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ, নিউজিল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ নারী প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডান প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১০১তম নোবেল শান্তি পুরষ্কার অর্জন করেছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘাত ও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দুর্ভোগে থাকা মানুষের ক্ষুধা নিরসনে অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও, জাতিসংঘের এই অঙ্গ সংস্থা খাদ্য সুরক্ষাকে শান্তির উপকরণ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিক সহযোগিতায় মূল ভূমিকা পালন করেছে। যুদ্ধ ও সংঘাতের অস্ত্র হিসেবে ক্ষুধার ব্যবহারকে মোকাবেলা করে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে একত্রিত করার জন্য জোরালো অবদান রেখেছে।
১৯৬০ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক কনফারেন্সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “ফুড ফর পিস” কর্মসূচীর পরিচালক জর্জ ম্যাকগভার্ন একটি বহুপাক্ষিক খাদ্য সাহায্য প্রদানকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৬১ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৩ সালে জাতিসংঘের এই অঙ্গসংস্থাটি সুদানের ওয়াদি হালফা অঞ্চলের নুবিয়ান জনগোষ্ঠীর জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ৩ বছর মেয়াদী সহায়তা কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রথমবারের মত নিজেদের কার্যক্রম শুরু করে। কর্মসূচীটি সফল হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়িত হতে থাকে। এর সদর দপ্তর রোমে অবস্থিত। এছাড়াও বিশ্বের ৮০টিরও দেশে এর শাখা রয়েছে। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী এই সংস্থা ৮৮ টি দেশে প্রায় ১০ কোটি মানুষকে সেবা প্রদান করেছে।
ক্ষুধা ও খাদ্য-নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশ্বের বৃহত্তম সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী স্কুল মিল প্রদানকারী বৃহত্তম সংস্থাও এটি। জাতিসংঘ উন্নয়ন গ্রুপের নির্বাহী সদস্য হিসেবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ২য় লক্ষ্য অর্থাৎ “জিরো হাংগার”-কে কেন্দ্র করে কাজ করে। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে সংস্থাটি ব্লকচেইন এবং ডিজিটাল আইডেন্টিটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে জর্ডানে অবস্থানকারী সিরীয় উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্য সরবরাহ এবং তার সুষম বন্টন নিশ্চিত করে। চলতি বছরে ইয়েমেন সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত ১২ মিলিয়ন মানুষকেও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী খাদ্য সহায়তা প্রদান করে। করোনাভাইরাস মহামারির সময় বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির আরও শঙ্কা জেগেছে। ইয়েমেন, গণতান্ত্রিক কঙ্গো, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া, এবং বুরকিনো ফাসোর মতো দেশগুলোতে সহিংস সংঘাত ও মহামারির সংমিশ্রণে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দুঃসময়ে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তার প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করেছে। তারা নিজেরাই ঘোষণা দিয়ে বলেছে যে,’যতদিন পর্যন্ত (করোনাভাইরাসের) কোনো মেডিক্যাল ভ্যাকসিন আমরা না পাচ্ছি, ততদিন পর্যন্ত খাদ্যই সেরা ভ্যাকসিন,’ ।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এটি দুর্যোগকালীন সময়ে ত্রাণ সরবরাহ নিয়েও কাজ করে থাকে। এছাড়াও এটি কৃষকদের সমৃদ্ধি ও স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে “পারচেজ ফর প্রোগ্রেস” কার্যক্রমের আওতায় আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে প্রায় ৮ লক্ষ কৃষককে কৃষিপণ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং বাজারজাতকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী পরিচালিত “টেক-হোম রেশন” ও “স্কুল ফিডিং” প্রকল্পের আওতায় বিশ্বব্যাপী ৭১টি দেশে শিক্ষার্থীরা ক্ষুধামুক্তভাবে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। পাশাপাশি তাদের অভিভাবকরাও সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছেন এবং বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী, বিশেষত মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা লক্ষ্যনীয় ভাবে বেড়েছে। এভাবে ক্ষুধা ও অপুষ্টির সাথে লড়াই করে সংস্থাটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যান্য লক্ষ্য যেমন শিক্ষা, চাকরি নিশ্চিতকরণ, দারিদ্র নির্মূলকরণে কাজ করে যাচ্ছে।
আদতে ক্ষুধা ও সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট যোগাযোগ বিদ্যমান। সংঘাত ও যুদ্ধের ফলে খাদ্য সংকট ও ক্ষুধা দেখা দেয়। এমন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা যেকোনো সুপ্ত সংঘাতেরও ইন্ধন হিসেবে কাজ করে সহিংসতা বৃদ্ধি করতে পারে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ঠিক এই জায়গাতেই ক্ষুধাকে কেন্দ্র করে সংঘাত এবং সংঘাতের ফলশ্রুতিতে ক্ষুধা- এই দুটি অবস্থাকে প্রতিহত করতে কাজ করছে। এভাবে তারা কেবল একটি ক্ষুধামুক্ত পৃথিবীই নয়, একটি স্থিতিশীল, সংঘাতবিহীন শান্তির পৃথিবী তৈরির লক্ষ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি-ই এই বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়।
(Note: These portraits are made by Niklas Elmehed and are collected from official noble prize page )
Author : Subah Binte Ahsan
Authors Bio : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনিষ্টিটিউট,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।